গভীর রাতে কলিংবেলের শব্দে মুনার ঘুম ভেঙে গেলো। দরজা খুলে দেখে বাকের ভাই দাঁড়িয়ে।
– বাকের ভাই এত রাতে কেন?
বাকের ভাই অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “ না তুমি একা একটা মেয়ে এত রাতে, তাই দেখতে আসলাম। দেশের পরিস্থিতি তো ভালো না। বুঝো না? হাহা!”
মুনা বললো, “ দিনে আসতে পারেন না? আসুন ভেতরে আসুন। চা খেয়ে যান। “
বাকের আনন্দিত হয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, “ বুঝলা মুনা, দিনে তো আসার নিয়ম না। আমার ফাঁসি হয়ে গেছে না? কিভাবে আসবো? “
.
মুনা আর বাকের, দুজনে নীরবে চা শেষ করলো…..বাকের ভাই বললো, “ মুনা আমি যাই। “
মুনা বললো, “ গলির মুখে চায়ের দোকানে ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে’ গানটা শুনে না কেউ। রিকশাওয়ালা বড় ঝামেলা করে মাঝেমাঝে ভাড়া নিয়ে। আপনি তখন আসেন না কেন? থেকে যান বাকের ভাই। আপনি না থাকলে বড় একা হয়ে যাবো। “
বাকের কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো, “ একজন আগে চলে যাবে, বাকিরা তার স্মৃতি নিয়ে থেকে যাবে আরো কিছুদিন। এটাই স্বাভাবিক না মুনা? হিমুও তো চলে গেলো…..হলুদ পাঞ্জাবীটা তার মেসে পড়ে আছে অনেকদিন। মাজেদা খালার বাসি পোলাওটা অমৃতের মত খায় না কেউ। তরঙ্গ স্টোর থেকে রূপাকে কেউ ফোন করে না আজ প্রায় ছয় বছর। রূপাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে জানো? “
মুনা বললো, “ ভুল বললেন বাকের ভাই…..কেউ হারায়নি। হাজারো ঘরের কোণে এখনো হিমু রূপা বাকের ভাইরা আছে। মন খারাপের কোন মধ্যদুপুরে এখনো বুকশেলফ থেকে হিমু পিচগলা রাস্তায় হাঁটতে বের হয়। হিমু নেই, তবে হলুদ রঙটা হিমু হয়ে আছে এখনো। “
বাকের বললো, “ মুনা আমি যাই? “
মুনা বললো, “ আবার কবে আসবেন বাকের ভাই? “
– “ যদি তোমার মন কাঁদে….চলে আসবো এক বর্ষায়। দারুচিনি দ্বীপে রূপালি রাত্রি দেখে আসবো একবার। এক জোছনা রাতে সবাই বনে গেলে অনন্ত নক্ষত্রবীথি থেকে তোমাদের এই নগরে এসে জীবনের শেষ কটাদিন শঙ্খনীল কারাগারে থাকার গল্পটা শুনাবো। “
মুনা দেখলো, বাকের চলে যাচ্ছে…… স্ট্রিট লাইটের আলোতে বাকেরের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে একটা সময় মিলিয়ে গেলো। হঠাৎ মুনার মনে হলো, ছায়াটা বাকেরের না…..হিমুর…..কিংবা মিসির আলীর…..অথবা শুভ্ররও হতে পারে।
পরক্ষণে মুনার মনে হলো, এরা সবাই হারিয়ে গেছে দুই হাজার বারো সালের উনিশে জুলাই এক শ্রাবণে। এরপর থেকে আর কোথাও কেউ নেই। “
“উনিশে জুলাই”
সংগৃহীত